শনিবার, ২রা নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, English Version, ইপেপার

আফগানিস্তানে অমুসলিমদের সাথে বন্ধুত্ব নিষিদ্ধ করে যে আইন

আফগানিস্তানে অমুসলিমদের সাথে বন্ধুত্ব নিষিদ্ধ করে যে আইন

সম্প্রতি তালেবান প্রণীত নীতি–নৈতিকতাবিষয়ক আইনের কার্যকরী প্রয়োগ শুরু হয়েছে আফগানিস্তানে। এই আইনের আওতায় আফগানদের জন্য কঠোর বিধিনিষেধ মেনে চলা বাধ্যতামূলক হয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে নীতি পুলিশের সদস্যদের মাঠে এসে এই আইন কার্যকর করতে দেখা গেছে। তাছাড়া তালেবান সরকারের সদস্যদের হাতে নিগৃহীত হওয়ার ভয়ে আফগানরা নিজেদের স্বার্থে এই বিধিনিষেধ মেনে চলার চেষ্টা করছেন।

যুক্তরাষ্ট্র নেতৃত্বাধীন ন্যাটো জোটের সেনাদের আফগানিস্তান থেকে চলে যাওয়ার মাধ্যমে তিন বছর আগে তালেবানের রাষ্ট্রক্ষমতায় প্রত্যাবর্তন ঘটে। ক্ষমতায় আসার পর থেকেই তালেবান আফগানদের, বিশেষ করে নারীদের জীবনাচরণে বিভিন্ন ইসলামবিরোধী বিধিনিষেধ আরোপ করেছে। এবার আইন হিসেবে তা বাস্তবায়ন করা হয়েছে।

আইনটি ঘোষণার পর আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ব্যাপক সমালোচনা দেখা দিয়েছে। নারীদের প্রতি বিধিনিষেধ শিথিল করার যে প্রতিশ্রুতি তালেবান সরকার দিয়েছিল, তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। নতুন আইনের ৩৫ নম্বর ধারাটি বিশেষভাবে সমালোচিত হয়েছে। এই ধারায় বলা হয়েছে, নারীরা বাড়ির বাইরে উচ্চ স্বরে কথা বলতে পারবেন না। তাঁরা উচ্চ স্বরে গান গাইতে বা কবিতা আবৃত্তি করতে পারবেন না, এবং অনাত্মীয় পুরুষের দিকে তাকাতেও পারবে না। এছাড়া, আফগান নারীদের পুরুষদের পাশাপাশি অমুসলিম নারীদের সামনে বোরকা পরে যেতে হবে।

পুরুষদের জন্যও বিভিন্ন নির্দেশনা রয়েছে। তাঁদের মুষ্টির চেয়ে দাড়ি লম্বা রাখা ও ঢিলেঢালা কাপড় পরিধানের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। নারীদের শারীরিক অঙ্গ দেখা যাবে না এবং স্ত্রীর সঙ্গে পায়ুপথে যৌন সম্পর্ক স্থাপনেও নিষেধাজ্ঞা রয়েছে।

নতুন আইনে সংবাদমাধ্যমের জন্যও কিছু বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে। সংবাদমাধ্যমে ইসলামকে অপমান বা অবমাননাকর কোনো কিছু প্রকাশ করা নিষিদ্ধ। পরিবহন কোম্পানিগুলোকে নামাজের সময় অনুযায়ী তাদের যাত্রার সময়সূচি পরিবর্তন করতে বলা হয়েছে। মুসলমানদের অমুসলিমদের সাথে বন্ধুত্ব বা কোনো ধরনের সহযোগিতা করতে নিষেধ করা হয়েছে। এমনকি কিছু ঐতিহ্যবাহী খেলা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। স্মার্টফোন বা কম্পিউটারে জীবন্ত জিনিসের ছবি তোলাও নিষিদ্ধ। মা-বাবার কথা অমান্য করাকেও বেআইনি ঘোষণা করা হয়েছে।

তালেবান গত ২১ আগস্ট এই আইনের ঘোষণা দেয়। এরপর কয়েক সপ্তাহের মধ্যে আইনটি কার্যকর করতে তালেবান কর্মকর্তাদের নজরদারি বৃদ্ধি পায়। নীতি-নৈতিকতাবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের নীতি পুলিশ নতুন আইনটি ঠিকমত কার্যকর হচ্ছে কি না, তা দেখার দায়িত্ব পেয়েছে। রাজধানী কাবুলে নীতি পুলিশের টহল শুরু হয়েছে। কোনো নারী মাহরাম (পুরুষ আত্মীয়) ছাড়া এবং হাত বা চুল দেখা যাওয়া অবস্থায় ঘোরাফেরা করতে নিষেধ করা হচ্ছে।

কাবুলের ২৩ বছরের একজন তরুণ বলেন, ‘আমাকে তিনবার থামানো হয়েছে। তাঁরা জানতে চেয়েছেন, কেন আমি দাড়ি রাখিনি। আমি ভয় পেয়ে যাই এবং দাড়ি রাখার প্রতিশ্রুতি দিই।’ আফগানিস্তানের উত্তরাঞ্চলের মাজার-ই-শরিফের একজন ট্যাক্সিচালক বলেন, তাকে বেশ কয়েকবার সতর্ক করা হয়েছে কেন তিনি মাহরাম বা বোরকা ছাড়া নারীদের গাড়িতে তুলছেন।

কাবুলের একটি ব্যাংকের কর্মীরা নতুন আইন মেনে ঐতিহ্যবাহী পোশাক পরিধান করতে বাধ্য হচ্ছেন। ২০২১ সালে আফগানিস্তান থেকে মার্কিন নেতৃত্বাধীন সৈন্যদের বিতাড়িত করার পর তালেবান সরকার দেশটির নারী ও পুরুষদের বিচ্ছিন্ন রাখার ওপর চাপ দিচ্ছে। এই বিধিনিষেধের অনেকগুলো নতুন আইনে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে এবং ইতিমধ্যেই কার্যকর হয়েছে।

মেয়েদের মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে এবং তরুণীদের বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়াও নিষিদ্ধ। কোনো নারী ভ্রমণের সময় পরিবারের পুরুষ সদস্যের উপস্থিতি আবশ্যক। নারীদের প্রকাশ্যে বের হওয়ার সময় মাথা থেকে পা পর্যন্ত ঢাকা থাকতে হবে। নামাজ পড়া নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে বাধ্যতামূলক এবং প্রকাশ্যে গান গাওয়া ও জুয়া খেলা নিষিদ্ধ। জনগণের জমায়েত হয় এমন জায়গায় নারী ও পুরুষের আলাদা থাকতে হবে। ব্যভিচার, সমকামিতা ও মাদক গ্রহণ আগে থেকেই নিষিদ্ধ।

নতুন এই আইনটি তালেবানের সমাজের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ করে। আইনটিতে শাস্তির বিধানও উল্লেখ রয়েছে, যার মধ্যে মৌখিক সতর্কতা, হুমকি, জরিমানা এবং বিভিন্ন মেয়াদে আটক করার শাস্তি রয়েছে।

তবে তালেবান সরকার ঘোষিত আইনটি ব্যাপকভাবে অস্পষ্ট। এতে অনেক প্রশ্নের উত্তর নেই। নারীদের ‘জরুরি প্রয়োজন’ ছাড়া বাড়ি থেকে বের না হওয়ার নির্দেশনা রয়েছে, কিন্তু জরুরি পরিস্থিতির সংজ্ঞা কী, তা পরিষ্কার নয়। অমুসলিমদের সাথে বন্ধুত্ব নিষিদ্ধ করা হয়েছে, তবে এর মাধ্যমে আফগানদের আন্তর্জাতিক সংস্থার সঙ্গে কাজ করার অধিকার ক্ষুণ্ণ হচ্ছে কি না, তা স্পষ্ট নয়।

এটি এমনও হতে পারে যে, তালেবান সরকার পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক থেকে নিজেদের বিচ্ছিন্ন করে তাদের ‘একঘরে’ অবস্থানকে আরও শক্তিশালী করেছে। ফোন ও টেলিভিশনে গণমাধ্যম পরিচালনার নির্দেশনা কী হবে, তাও উল্লেখ করা হয়নি। তবে সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হলো, নতুন আইনটি কতটা সমানভাবে প্রয়োগ করা হবে।

জুলাই মাসে জাতিসংঘের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, দেশটির নৈতিকতাবিষয়ক পদক্ষেপ এবং এর প্রয়োগ নিয়ে ‘অস্পষ্টতা ও অসংগতি’ ছিল।